লক ডাউন
অনসূয়া মুখোপাধ্যায়
আবার লক ডাউন শুরু হয়েছে। সুতপা,সুতপার স্বামী আর দুই ছেলে।শুভায়ন ,সুমন। ছোট্ট সুখী পরিবার। শ্বাশুড়ি গত হয়েছেন দুবছর।নিরামিষের ঝঞ্ঝাট আর নেই তাই .সাতসকালে আর রান্না শুরু করতে হয়না। একটু বেলা করে ঘরের সব কাজ সেরে রান্নায় হাত দেয় সুতপা । এ কদিন বর বাড়িতেই ছিল, বাজার নিয়ে কোনো চিন্তা ছিলোনা,কিন্তু এখন লক ডাউন শুরু হলেও,ওদের অফিস খোলা ,ওদের জন্য বিশেষ ট্রেন , অফিসও যেতে হচ্ছে। বাজার এখন এক বিরাট সমস্যা। বড় ছেলে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ,টুকটাক বাজার হাট ছোটোছেলে সুমন ই করে। মোটামুটি মুখচোরা ,লাজুক ছেলেটা মায়ের বাধ্য। মায়ের মনখারাপ হলে ,পাশে বসে বলে —-কাঁদছো কেন ?”বলতে বলতে নিজের বড় বড় চোখদুটো জলে ভোরে ওঠে।

সুতপা ঠিক করলো আলুপোস্ত আর ডিমের ঝোল করবে,দুটোই সুমনের খুব পছন্দ। তার সঙ্গে পেঁয়াজ ,লঙ্কা কুচি দিয়ে মুসুরির ডালের বড়া । রান্না করতে গিয়ে দেখলো ডিম্ ও নেই পোস্ত ও নেই.,খোঁজ পড়লো সুমনের ,তিনি একমনে ছাদের কোনে প্লাস্টিকের বোতলে মাটি ভরছেন ,সারাগায়ে মাটি ,ঝুলন্ত টব বানাবেন ,নেট থেকে উদ্বুদ্ধ। দাদা কিন্তু এইসব হাবিজাবি করেনা ,নিজের পড়া নিয়ে ব্যস্ত। সুতপার মাথাটা ঝা করে গরম হয়ে গেলো। এই সক্কালবেলা অনলাইন স্কুলের ক্লাস ছেড়ে বাগান করছে !তাও যদি ঠিকঠাক করতে পারতো। ইউ টিউবের পান্ডিত্য। এই ছেলেটা জ্বালিয়ে খেলো। পরের বছর যে উচ্চমাধ্যমিক একটুও চিন্তা আছে ? “ সুমন” চিৎকার শুনে-চমকে উঠে বললো ,”নেট নেই মা“ বাহ্ আর পায় কে.
সুতপা একটা ছোট ব্যাগ আর ৫০০ টাকার নোট সুমনকে দিয়ে বললো — “ টাকাটা আবার হারিয়ে ফেলিসনা ,কি ভাবতে থাকিস সারাদিন ভগবানই জানে ,২ দিন আগেই ১০০ টাকা নালিতে ফেলেছিস।
কাচু মাচু মুখ করে বললো “ইচ্ছা করে ফেলিনি মা ,একটা সাইকেল এসে ধাক্কা দিলো ,তাই হাত থেকে পড়ে গেল”.
রাস্তায় বেরিয়ে মাথা নীচু করে হাঁটছিলো সুমন। মাথা তুলে হাঁটতে ভাল লাগেনা । ও জানে ১৭ বছর বয়েসে ওর এই অল্প ভুঁড়ি ,৫ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা শরীর কারুর নজর কাড়েনা। চটি ঘষটাতে ঘষটাতে ওর হাঁটাটা খুব ক্লান্তিকর ,চোখ খুলে ও সারাদিন স্বপ্ন দেখে। একদিন ও ওর দাদার মতন সবার চোখে হিরো হয়ে উঠবে। দাদার মতন চুল ঝাঁকিয়ে মেয়েদের দিকে যখন তাকাবে ,মেয়েদের মনে শুধু তখন ও।
`‘এইই লাল্টুস কোথায় চললি ?”——“গা জ্বালা করে এমন ডাক শুনলে , উত্তর না দিয়েও উপায় নেই ,বাবার বন্ধু ,এতো বয়স্ক মানুষ,কেমন করে যে এমন হালকা ঠাট্টা করে !”পায়ের সামনের প্লাস্টিক টাকে এক লাথি মেরে মনের ঝাল মিটিয়ে মাথা তোলে সুমন। ———দোকানে –
“——–হেঁ হেঁ এই দোকান আর বাড়ি সারাদিন করে বেড়া ,পড়াশোনাতো হবেনা। “
“—পড়াশোনা হবেনা কেন !৫/২ হলে পড়াশোনা হয়না !দাদার মতন ৬ ফুট হতে হবে?তাহলেই বুঝি ৯৮.৫% নাম্বার পাওয়া যায় ? শুধু পড়াশোনা করতে হবে?খেতে ভালোবাসতে পারা যাবেনা !”চোখ জলে ভোরে আসে সুমনের।
রাস্তার ওধারে পল্টুকার দোকান ছাড়িয়ে মোড়ের মাথায় মানুষের মাথা গিজ গিজ করছে ,কারুর মাস্ক থুতনিতে কারুর কানে কারুর গলায় ,প্রচুর হৈ – হট্টগোল। কৌতূহল হচ্ছে কিন্তু যাবার সাহস নেই,দেরি হলে মা রাগ করবে। পল্টুকাকে গড়গড় করে জিনিসগুলো বলে গেল ,”পল্টুকা তাড়াতড়ি দাও,মা এখনো রান্না শুরু করেনি ,দেরি হলে রাগ করবে”–
—দাঁড়ারে ,ওরকম রেলগাড়ী চালালে হবেনা ,আজ না হয় তোদের বাড়ির রান্না একটু দেরিতেই হবে ,দেখছিস না এই লক ডাউনেও চুরি করতে বেরিয়েছে ,পাবলিকের কেলানি কাকে বলে এবার বুঝবে বাছা ধন।
সুমন ঝুঁকে দেখলো ওরই বয়সি ছেলেটা। যে যেমন পারছে হাতের সুখ করে নিচ্ছে ,.দাদারই মতন লম্বা ,পেটানো চেহারা ,ঝাঁকড়া চুল সব রক্তে মাখামাখি ,ল্যাম্পোস্টের গায়ে কেমন শক্ত করে বাঁধা, চোখগুলো ফুলে পুরো বন্ধ ,আর তাকাতে পারছেনা ,গলা ঠেলে বমি আসছে। —–পল্টুকা তুমি আমাকে দাও,দেরি হয়ে যাচ্ছে।
“ওমা!—- ছেলেটা রক্তবমি করছে ,কেউ দেখতে পাচ্ছেনা ?ওতো মারা যাবে !”ভিড় ঠেলে ঘষ্টানো চটি নিয়ে চিৎকার করতে করতে ভিড়ের মধ্যে ঢুকলো সুমন।
এই কি করছো তোমরা ,ওতো মারা যাবে !-
তুই থাম ,লালটুসের চোরের জন্য দরদ উথলে উঠলো।
না তোমরা এমন করে মারতে পারোনা ,চুরি করলে পুলিশে খবর দাও।
তুই থাম ,মেলা কপ চাস না
কে একটা ভাঙ্গা পাথড়ের চাঙ্গর ছুঁড়ে মারলো।
“এই কি করলি কি করলি ?” ভেসে এলো বাবার বন্ধুর গলা.
সমস্ত ভিড় এক নিমেষে ফাঁকা ,একটা লোকও নেই। শুধু রাস্তায় পরে আছে লাল্টুস সুমনের নিথর দেহ।